বৃহস্পতিবার ১৪ আগস্ট ২০২৫ - ১১:৫৭
জয়নাবি পদযাত্রা

মানবজাতি ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে, ব্যক্তি ও সমাজ উভয় স্তরে, এক গভীর আধ্যাত্মিক অর্থের সন্ধান করেছে। সেই অনুসন্ধানের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিফলন হলো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও হিজরতের যাত্রা। এই প্রেক্ষাপটে, আরবাঈন পদযাত্রা কেবল একটি বিশ্বাসের প্রকাশ নয়, বরং এক সমষ্টিগত চেতনা ও আত্মিক গভীরতার অভিযাত্রা।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: প্রতি বছর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শাহাদাতের স্থান— ইরাকের কারবালার উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে যাত্রা করেন। এই ইবাদত ইসলামী বিশ্বে জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং ন্যায়ের প্রতীকে রূপ নিয়েছে। এটি শুধু অতীতের এক ট্র্যাজেডি স্মরণে সীমাবদ্ধ নয়; বরং আজকের পৃথিবীতে ন্যায়, ঐক্য, ধৈর্য ও ভাগাভাগির মতো কুরআনিক মূল্যবোধের বিরল সমষ্টিগত প্রকাশ।

ফলে, আরবাঈন পদযাত্রা একদিকে ব্যক্তির অন্তর্গত রূপান্তর ঘটায়, অন্যদিকে সমাজকে মুহাম্মাদি মূল্যবোধের ভিত্তিতে পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়। দীর্ঘ ও কষ্টকর এই সফর অনেকটা আখেরাতের পথে যাত্রার দুনিয়াবি প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি পদক্ষেপে মানুষ নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে, ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় এবং এই হুসাইনি যাত্রায় দুনিয়াকে পেছনে ফেলে সত্য ও অনন্তের দিকে অগ্রসর হয়।

যদিও বাইরে থেকে এটি একটি শারীরিক পদযাত্রা বলে মনে হয়, মূলত এটি আত্মা, বিবেক ও সমাজ— এই তিন স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত গভীর এক সম্পর্কের চর্চা। সীমান্ত অতিক্রম করে মানুষ কারবালার পথে পা বাড়ালেও, আসলে এটি একটি অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি ও উন্নতির পথচলা— যেখানে ব্যক্তি নিজের দুর্বলতার সঙ্গে লড়াই করে এবং সমাজের সাথে পুনঃসংযোগ স্থাপন করে।

কুরআনুল কারিম বহু আয়াতে ব্যক্তির সামাজিক দায়িত্ব ও ভ্রাতৃত্ববোধের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। আরবাঈন পদযাত্রায় এসব নীতি জীবন্ত রূপ পায়। যেমন— “তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো; বিভক্ত হয়ো না” (আলে ইমরান ৩:১০৩)

এই আয়াতের মর্ম এখানে বাস্তব হয়ে ওঠে— নানা দেশ, মাযহাব ও সংস্কৃতির মানুষ ইমাম হুসাইন (আ.)-এর উদ্দেশ্যে এক কাতারে মিলিত হয়। এটি ইসলামী উম্মাহর সম্ভাব্য ঐক্যের প্রতীক ও উদাহরণ।

আরেকটি উজ্জ্বল দিক হলো নিঃস্বার্থ সেবা ও সহযোগিতা। পথে হাজার হাজার সেবা-শিবির (মাওকিব) বিনা পারিশ্রমিকে খাদ্য, পানি, আশ্রয় ও চিকিৎসা প্রদান করে। এটি— “সৎকর্ম ও তাকওয়ার ব্যাপারে একে অপরকে সাহায্য করো” (মায়েদা ৫:২)

আয়াতটির প্রকৃত প্রতিফলন। অংশগ্রহণকারীরা কেবল নিজের প্রয়োজন মেটান না, বরং ভাগাভাগি, সহমর্মিতা ও অপরের প্রতি নজর রাখার গুণ আত্মস্থ করেন।

এই যাত্রা এক কঠিন ধৈর্য ও স্থিতিশীলতার পরীক্ষা। প্রতিদিন বহু কিলোমিটার হাঁটা, ভিড়ের মধ্যে অগ্রসর হওয়া, শারীরিক কষ্ট সহ্য করেও অবিচল থাকা— এসব ব্যক্তির ধৈর্যকে দৃঢ় করে। এখানে— “নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন” (বাকারা ২:১৫৩)

আয়াতের তাৎপর্য প্রতিনিয়ত অনুভূত হয়। এই ধৈর্য ব্যক্তিগত যেমন, তেমনি সামষ্টিকও— মানুষ একে অপরকে সহ্য করে, সহযোগিতা করে, একসাথে চলতে চলতে এক যৌথ চেতনা গড়ে তোলে।

পাশাপাশি, এই জয়নাবি পদযাত্রা শহীদ হওয়ার মাহাত্ম্য নতুনভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। কুরআন বলে— “আল্লাহর পথে নিহতদের মৃত বলো না; তারা জীবিত” (বাকারা ২:১৫৪)

ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর সাথীদের কারবালার আত্মত্যাগ সেই চিরন্তন জীবনের প্রতীক, যা আরবাঈন পদযাত্রা প্রতি বছর নবজীবন দান করে। এটি শহাদতের চেতনাকে জাগ্রত রাখার এক সমষ্টিগত স্মৃতির ধারাবাহিকতা— যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সংগ্রামকে শুধু ইতিহাসে নয়, বরং উম্মাহর আত্মিক সত্ত্বায় চিরজীবী করে রাখে। এখানে ব্যক্তি নিজেকে অতিক্রম করে এবং সমাজ ন্যায়, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও ধৈর্যের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত হয়।

যেমন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কারবালার শাহাদাত ইসলামের জাগরণের প্রতীক, তেমনি আরবাঈন পদযাত্রা সেই জাগরণের পুনর্জাগরণ— যা লক্ষ লক্ষ মানুষ হযরত জয়নাব (আ.)-এর ধৈর্য ও সাহসের কেন্দ্রবিন্দুতে প্রতিবছর নতুনভাবে পালন করে। এভাবে এই সফর আখেরাতের প্রস্তুতির এক দুনিয়াবি মহড়াতে রূপ নেয় এবং ব্যক্তি ও সমাজ উভয়কে ফিতরতের পবিত্র সূচনাবিন্দুর দিকে ফিরিয়ে আনে।

সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha